একজন ভ্রমণকারী হিসেবে আপনি জীবনে হয়ত অনেক জায়গা ঘুরতে যাবেন, অনেক কিছু দেখতে পারবেন। কিন্তু মহান আল্লাহ তা’আলার অসাধারণ এক সৃষ্টি যদি দেখতে চান, তাহলে নাফাকুম জলপ্রপাতের মত দ্বিতীয় কোন স্থান এদেশে খুব কমই আছে।

বান্দরবনের গহীনে ,রেমাক্রি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান এই জলপ্রপাতের। থানচি থেকে নৌকায় করে রেমাক্রি পৌছানোর পর এক রাত থেকে আমরা ৫ জনের একটি গ্রুপ গিয়েছিলাম এই জায়গায়। রেমাক্রি থেকে ২-৩ ঘন্টার ট্রেকিং করে আপনি এই জায়গায় পৌছাতে পারবেন। আগে কখনও ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা না থাকলে পথে কিছুটা কষ্ট হতে পারে, তবে যখন সব কষ্ট সহ্য করে আপনি জলপ্রপাতের কাছে পৌছাবেন, তখন এর সৌন্দর্য্যে আপনার সব কষ্ট দূর হতে বাধ্য!

সাবধানতা এবং কিছু পরামর্শঃ

১। গ্রুপে যত বেশি মানুষ হবে খরচ তত কমবে। আমরা যদিও ৫ জনের গ্রুপ ছিলাম, তারপরেও আমি মনে করি অন্তত ৮ জনের গ্রুপ হলে স্বাছ্যন্দভাবে ঘুরে আসতে পারবেন।

২। থানচি থেকে নৌকা নেয়ার সময় ভুলেও কোন মাঝির এমন কথায় বিভ্রান্ত হবেন না যে ” আমার নৌকা আছে, তবে আমিও একজন গাইড, আপনাদের নিয়ে যেতে পারবো”। এ সমস্ত কথা বলে কিছু মাঝি বাড়তি টাকা আদায় করতে চায়। আলাদাভাবে অবশ্যই একজন গাইড নিবেন।

৩। থানচি পৌছানোর পর আপনার সর্বপ্রথম কাজ হবে ট্যুরিস্ট অফিসে যাওয়া। সেখানে গিয়ে যদি আপনি আপনার রুটের কথা তাদেরকে বলেন তাহলে তারাই আপনাকে একজন গাইডের ব্যাবস্থা করে দিবে, অথবা আপনাকে সম্পূর্ণ প্রসেস বুঝিয়ে দিবে।

৪। যাওয়ার আগে অবশ্যই যারা যাবেন তাদের সবার অথবা অধিকাংশের স্টূডেন্ট আইডি কার্ড/ভোটার আইডি কার্ড/যেকোন ধরনের পরিচয় পত্র নিয়ে যাবেন। গাইড সহ থানায় নাম লিখাতে গেলে সবার আইডির ফটোকপি জমা দিতে হয়। আমরা ৫ জন গেলেও আমাদের মধ্যে ২ জনের আইডি কার্ড ছিলো। প্রথমে এ ব্যাপারে রাজি না হলেও পরে ২ জনের কার্ডের ফটোকপি দিয়ে কাজ হয়েছিল।

৫। থানচির পর ফোনে নেটওয়ার্ক থাকবে না, তাই থানচিতে থাকা অবস্থাতেই প্রিয়জনের সাথে কথা বলে নিবেন।

৬। থানচি থেকে রওনা দেয়ার আগে কিছু শুকনা খাবার কিনে নিতে পারেন। অথবা থানচি বাজার থেকেও খেয়ে নিতে পারেন। বাজারের খাবার আমাদের কারওই অতটা ভালো লাগেনি।

৭। রেমাক্রি পৌছানোর পর গাইড আপনাদেরকে কটেজে নিয়ে যাবে। রেমাক্রি ফলস এর পাশেই কিছু ভালো কটেজ আছে। আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে এক আদিবাসি মহিলা আমাদের রাতের খাবারের আয়োজন করেছিলো। ওখানকার যে কারো চাইতে ওনার রান্না অনেক বেশি মজার। কটেজের নাম এবং সব ডিটেইলস নিচে দেয়া আছে।

৮। সাধারনত রেমাক্রি পৌছানোর পর আরেকজন গাইড নিতে হয় নাফাকুমের জন্য। কিন্তু আমাদের সাথে থানচি থেকে একজন আদিবাসি ছেলে রেমাক্রি পর্যন্ত গিয়েছিল যে আমাদেরকে পরে নাফাকুম নিয়ে গিয়েছে। তাকে থানচি থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদাভাবে কোন টাকা দিতে হয়নি। একটা কথা বলতেই হবে যে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষেরা কতটা সহজ সরল এবং মনের দিক দিয়ে কতটা পরিষ্কার, তা এই ছেলেটাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। আপনি যদি নাফাকুম যেতে চান, তাহলে এর চাইতে ভালো ব্যাবহার এবং সরল মনের গাইড আর পাবেন না। সে এতটাই ভালো ছিল যে আমরা ঢাকা আসার পর সে আমাদের ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে যে আমরা ঠিকঠাক মত পৌছেছি কিনা, এবং এটাও জানিয়েছে যে আমরা চলে এসেছি দেখে তার মন অনেক খারাপ হয়েছিল।  তার নাম এবং ফোন নাম্বার পোস্টের শেষে দেয়া আছে।

৯। নাফাকুম যাওয়ার পথটা কিছু যায়গায় কঠিন। বেশিরভাগ যায়গাই ভালোমত হেটে পার করতে পারবেন। তবে আমরা শীতকালে গিয়েও অধিকাংশ যায়গা পিচ্ছিল অবস্থায় পেয়েছি আর আমাদের গ্রুপের সবাই অনেকবার বার পিছলা খেয়ে পরেছি। তাই হাটার সময় অত্যন্ত সাবধান থাকবেন। 

১০। হাটার রাস্তায় অনেক সুন্দর কিছু যায়গা আপনার চোখে পড়বে, তাই যাওয়ার সময় ছবি তুলতে ইচ্ছা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যতই ছবি তোলার জন্য দাড়াবেন ততই পৌছাতে দেরি হবে। যেতে আড়াই ঘন্টার বেশি লাগে না কিন্তু যদি ছবি তুলতে দাড়ান তাহলে ৩ ঘন্টার বেশিও লাগতে পারে। আমি সাজেস্ট করবো যাওয়ার সময় হাটা অবস্থায় যতটুকু তুলতে পারেন তা তুলে নিয়ে ফেরার সময় বাকি ছবি তোলা।

১১। পানিতে নামলে নিজের মুল্যবান জিনিসগুলো সেফ রাখার জন্য অবশ্যই পলিথিন নিবেন।

১২। রেমাক্রিতে ইলেকট্রিসিটি নেই। জেনারেটর সাধারনত রাত ১০ টা পর্যন্ত চালু থাকে। এর মাঝেই মোবাইল, ক্যামেরার ব্যাটারি, ল্যাপটপ ইত্যাদি চার্জে দিয়ে নিবেন। একটা মাল্টিপ্লাগ অবশ্যই নিবেন।

খরচঃ

আমাদের ৫ জনের জনপ্রতি বাজেট ছিলো ৪ হাজার টাকা। কিন্তু আনুসাংগিক খরচ সাপেক্ষে অনেকের তা কম বেশি হতে পারে।

ঢাকা-বান্দরবন বাস ভাড়া= ৬২০*২= ১২৪০/=।
বান্দরবনে সকালের নাস্তা=জনপ্রতি ৮০/= টাকা।
বান্দরবন-থানচি বাস ভাড়া= জনপ্রতি ২০০/= টাকা।
থানচিতে দুপুরের খাবার= জনপ্রতি ১২০/= টাকা।
থানচি-রেমাক্রি নৌকা এবং গাইড খরচ= জনপ্রতি ৯০০/= টাকা।
রেমাক্রিতে প্রতিরাতে থাকা এবং খাওয়ার খরচ= জনপ্রতি ৩০০/= টাকা।
রেমাক্রিতে সকালের নাস্তা= জনপ্রতি 50/= টাকা।
রেমাক্রি-নাফাকুম গাইড খরচ= জনপ্রতি ১০০/= টাকা।
থানচি থেকে আমরা অন্য একটি গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে চাঁদের গাড়িতে বান্দরবন পর্যন্ত এসেছিলাম। গাড়ির খরচ ছিলো ৪৫০০/= টাকা। সর্বমোট ছিলাম ৯ জন। জনপ্রতি খরচ হয়েছিল ৫০০/= টাকা
টোটাল= ৩৪৯০/=

*খরচের ব্যাপারে কিছুটা এদিক-ওদিক হতে পারে। যেমন বান্দরবন আসার পথে আমরা নিলগিরি থেমেছিলাম। সেখানে গাড়ি পার্কিং এর জন্য ৩০০/= টাকা লাগে। আর এন্ট্রি ফী জনপ্রতি ৫০/=। এছাড়া ঢাকা-বান্দরবন-ঢাকা রুটে কুমিল্লায় যখন ব্রেক দিবে, তখন হালকা নাস্তায় কিছু খরচ পরবে যা আমাদের মোট বাজেটের মধ্যেই হয়ে গিয়েছিল।আবার, আমরা থানচি থেকে বান্দরবন ফেরার পথে পাহাড়ি কলা কিনেছিলাম ২ ডজনের মত। ৩০০ টাকার বড়ই কিনেছিলাম, আচার কিনেছিলাম। রেমাক্রি থেকে থানচি আসার পথে বৃষ্টি থাকায় বড় প্লাস্টিক কিনেছিলাম ব্যাগ ঢাকার জন্য। এসব আনুসাঙ্গিক খরচে খরচ কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। আপনি যদি ৫ জনের গ্রুপ হিসেবে যান, তাহলে ৪০০০-৪৫০০/= এর মত খরচ পরবে*

উল্লেখ্য যে, রেমাক্রিতে আপনার সাথে যে গাইড যাবে, তার থাকা খাওয়ার খরচ আপনার। গাইডের থাকা খাওয়ার খরচ এখানকার হিসাবে দেয়া হয়নি।

**সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। নাফাকুম যাওয়ার পথে, কিংবা রেমাক্রিতে কোথাও চিপসের প্যাকেট,বিস্কুটের প্যাকেট, কলার খোসা, পানির বোতল ফেলবেন না। নাফাকুম ট্রেকিং এর পথে নদীর ধারে ট্যুরিস্টদের ফেলে যাওয়া এসব অনেক আবর্জনা দেখেছি আমরা। সেখানকার স্বর্গীয় সৌন্দর্য্যের মধ্যে এধরণের আবর্জনা দেখা আসলেই অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার।**

দরকারি নাম্বারঃ

গাইডঃ ওশিয়াও মার্মা- 01585838832
কটেজঃ মেলডি গেস্ট হাউস। (আদিবাসি মহিলার নামঃ লালপিয়াম)।

আপনার যাত্রা শুভ হোক!

লেখাঃ Navid Redwan Talha