➡ ভ্রমণ যাত্রাঃ ২৮-০৯-২০১৯ (এক রাত দুইদিন)
➡ দর্শনীয় স্থানঃ
  • ✔ মারায়নতং সামিট,
  • ✔ শিলবুনিয়া ঝর্ণা,
  • ✔ আলির গুহা,
  • ✔ ডিম পাহাড়,
  • ✔ তংপ্রা ঝর্ণা,
  • ✔ দ্য মাইটি দামতুয়া ফলস।
পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিতে গত বছর সেপ্টেম্বরের লাস্ট উইকে আলিকদম গিয়েছিলাম সদলবলে, ছিলাম আমরা তেরো জন। ফর গড সেক জীবনের সেরা দুইটা দিন ছিলো সবার, অনায়াসে বলতে পারি। ট্যুরের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকে নানান প্ল্যান সাজাচ্ছিলাম, ফার্স্ট প্ল্যান ছিলো মারায়নতং’এ ক্যাম্পিং… আনফরচুনেটলি আমাদের ট্যুরের মাত্র এক সপ্তাহ আগে মারায়ন তং থেকে এক রাত্রিবেলা আর্মি কর্তৃক ক্যাম্পিংরত শ’খানেক ট্যুরিস্টদের নামিয়ে দেয়ার মত ফালতু কাহিনি হওয়ার পর সেই প্ল্যান মাঠে মারা যায়। মন কিছুটা দমে গেলেও ট্যুরে এর প্রভাব যেন না পরে সেই জন্যে প্ল্যানে কিছুটা চেঞ্জ আনি, ঢাকা থেকেই আলিকদম বাজারের কাছেই ‘হোটেল দামতুয়া ইন’এ তিন রুম বুক করে ফেলি। এরপর যথারীতি সপ্তাহখানেক আগেই তেরোটা টিকিট কেটে ফেলি সায়দাবাদ থেকে শ্যামলীর, যেন পরে সিট নিয়ে কোন ঝামেলা পোহাতে না হয়…
যাত্রার দিন রাতে খুশি মনে বাসে উঠে পরি সবাই, বাস ছাড়ে সায়দাবাদ থেকে নয়টার দিকে। বাসে একদম সামনের সব সিট আমাদের হওয়ায় ড্রাইভার মামা, সুপারভাইজার, হেল্পার সবার সাথে সেই ভাব হয়ে যায় যেতে যেতে আমাদের। ভোরের দিকে বাসে বসেই পাহাড়ের খাঁজে মেঘের আটকে পড়া দেখে আমরা অতি এক্সাইটমেন্টে লাফাচ্ছিলাম, সামনে তো পুরো ট্যুর বাকিই তখন।
➡ ১ম দিন ও ১ম রাতঃ সকাল ছয়টার দিকেই আমরা আলিকদম সদরের আগে শিলবুনিয়া পাড়ার রাস্তায় বাস থেকে নেমে গেলাম, দেন পাশেই বেশ কিছু হোটেল আছে সেখান থেকে একটা হোটেলে নাস্তার অর্ডার দিয়ে ফ্রেশ হলাম সবাই। নাস্তা করে হোটেলে সব ব্যাগ রেখে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সারে সাতটার দিকেই মারায়ন তং উঠা শুরু করলাম – ভাইরে ভাই, মারায়ন তং যেন একটা চ্যালেঞ্জ। সাপের মত একেবেকে একদম সোজা উপরে চলে গেছে ইট বিছানো রাস্তা, তাও আবার এদিক অদিক শ্যাওলা পড়া – কি যে বিদিকে পরে গেছিলাম সবাই, পরাণ যায় যায় অবস্থা! অবশ্য দশটার মধ্যেই চূড়ায় উঠে গিয়েছিলাম সবাই বলা যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগেছিলো আমাদের। তারপর মুগ্ধতা নিয়ে চারপাশ অবলোকন করতে করতে আর ইচ্ছে করছিলোনা নামতে ওখান থেকে। আকাশ ভরা মেঘ তখন, অদূরে বৃষ্টি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে! এই অনুভুতি বুঝিয়ে বলার মত না আসলে – একটা মাচার মত ঘর দেখেছিলাম উপরে, সেখানে বসে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে আর মনের মত করে পিক-টিক তুলতেছি যখন সবাই – হায়রে কি যে বৃষ্টি শুরু হলো তখন, তারাতারি নামতে শুরু করলাম ভয়ে। যেই পিছলা আর ঢালু পথ, নামতেও কম কষ্ট হয় নাই ভাই! আর নামার পুরোটা পথ বৃষ্টি অনবরত পড়ে কষ্ট দিগুণ বারিয়ে দিচ্ছিলো…
মারায়ন তং থেকে নেমেই নিচের এক টং দোকানে বসে চা সিগারেট পর্ব শেষ করে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করেই ছুটলুম শিলবুনিয়া ঝর্ণার পানে, ট্র্যাকিং করে জাস্ট দশ-পনেরো মিনিট হেটেই পৌঁছে গেলাম ছোট কিন্তু সুন্দর ঝর্ণাধারায়। ঐ পরিশ্রমের পর এইটুকু অবগাহন আমাদের প্রাপ্য ছিলো আসলেই। ঝর্ণা দেখে সকালের ঐ খাবার হোটেলে ব্যাক করতে করতে প্রায় দেড়টা। ক্ষিদেও কম ছিলো না কারো, রাক্ষসের মত দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। হোটেলের সার্ভিসে থাকা সবাই ছিলো অত্যন্ত অমায়িক। খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই রেডি হয়ে দুইটা অটো নিয়ে রওনা হলাম বিখ্যাত আলির গুহার তালাশে…
আলির গুহা…?? আহা! কি যে জিনিসরে ভাই… সেই ভালো লেগেছিলো। গুহায় ঢুকার আগে এক জায়গায় অটো দাড় করিয়ে নৌকা দিয়ে মাতামুহুরি পাড় হতে হয়, ঠিক তারপরেই অবশ্য গুহা – আমরা যখন গুহায় ঢুকি, তার মিনিট পনেরো আগে থেকেই ইচ্ছেমত বৃষ্টি পড়ছিলো। মূলত সারাদিন বৃষ্টিই ছিলো ঐদিন বলা যায়। এর মধ্যেই গুহায় ঢুকে একেকজনার অন্য এক দুনিয়ায় হারায়ে যাওয়া, এইরকম সুযোগ তো আর দিনে দিনে আসে না আমাদের সবার – ফলে অন্যরকম এক ফিল হচ্ছিলো সবার মাঝেই। গুহা দেখে ঢাকা থেকে বুকিং করে রাখা ‘হোটেল দামতুয়া ইন’এ চলে গেলাম সবাই, যেতে যেতে গোধূলি মিলিয়ে গেছে ততক্ষনে পশ্চিম আকাশে… সারাদিনের পরিশ্রম চোখেমুখে লেগে ছিলো যেন সবার। গোসল করে, খেয়ে দেয়েই সব ঘুম। অবশ্য পরদিনের জন্যে চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ আর ঢাকায় যাবার বাসের অগ্রিম টিকিট কেটে রাখতে ভুলিনি কিন্তু।
➡ ২য় দিন ও ২য় রাতঃ রাতে রিজার্ভ করে রাখা চাঁদের গাড়ি সকাল ছয়টার মধ্যেই চলে এসেছিলো হোটেলের পারকিং লটে। আমরা দ্রুত যে যার মত রেডি হয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি আলিকদম বাজারে নিয়ে গেলো সকালের নাস্তার জন্যে। নাস্তা করেই বিখ্যাত ‘আলিকদম টু থানচি’ রোডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। বান্দরবানের এইসব পাহাড়ি রাস্তাগুলিতে চাঁদের গাড়িতে চড়ে বেড়ানোর যে ফিলিংস, তা হয়তো গ্রুপে যারা আছে তাদের প্রায় সবারই জানা… গলা ফাটিয়ে গান গাইতে গাইতে একসময় চলে আসলাম ডিম পাহাড়ে। আলিকদম-থানচি আঞ্চলিক সড়ক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবথেকে উঁচু রাস্তা। আলীকদম থেকে এই রাস্তা উপরের দিকে উঠেছে এবং ডিম পাহাড়ের কাছাকাছি রাস্তার উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ২৫০০ ফুট। আলীকদম উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দুরের থানচি-আলীকদমে ডিম পাহাড়ের পুরোটাই পাহাড়ী পথ। তো বুঝতেই পারছেন মেঘের ভেলায় যেন চড়ছিলাম, অথচ ফিলিংস হচ্ছে রোলার কোস্টারে চড়ার… হা! হা! হা!
ভালো কথা, দামতুয়া যাওয়ার পথে ১০ কিলো আর্মি ক্যাম্পে আমাদের পারমিশন নেয়ার জন্যে থামতে হয়েছিলো। এখানে বলে রাখি, বারোটার পরে আর্মি সাধারণত পারমিশন দেয় না দামতুয়ায় যাওয়ার। আর অবশ্যই পাঁচটার মধ্যে ফিরতে হবে, এমন বলে দেয়। তারপর ১৭ কিলো বা আদু-পাড়া থেকে দামতুয়ার উদ্দেশ্যে ট্র্যাকিং শুরু করতে হয়, স্থানীয়ভাবে এখানে গাইড ঠিক করে দেয়া হয় – আমরা যখন ট্র্যাকিং শুরু করলাম, মনে হচ্ছিলো যেন অদ্ভুত সুন্দর কোন দুনিয়ায় চলে যাচ্ছিলাম। পাহাড়ের গহীনে হারিয়ে যাওয়ার যে নেশা, সে নেশার তুলনা চলেনা আসলে।
দামতুয়ায় যাওয়া আসা মিলে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টার ট্রেকিং। ঝর্ণায় পৌঁছাতে হলে পার হতে হয় ৫ টি খাড়া পাহাড়, বেশ অনেকগুলো ঝিরিপথ এবং ৪ টি পাড়া (পামিয়া মেম্বার পাড়া, তামতই পাড়া, নামসাক পাড়া, কাখই পাড়া)। রয়েছে ব্যাং ঝিরি, ওয়াংপা ঝর্ণা, দূর থেকে তংপ্রা ঝর্ণা। আদুপাড়া থেকে দামতুয়া ঝর্ণা পর্যন্ত পুরো পথই সবুজ আর সবুজ। মাঝে এক পাহাড় থেকে দুরের তংপ্রা দেখা যায়। আর ঠিক ঝর্ণার অল্প একটু আগেই পথের পাশেই পরবে অনন্য সুন্দর এক ক্যাসকেড। নাম ব্যাং ঝিরি, এত্ত জোস। দারুন শারীরিক পরিশ্রম হয়েছিলো এই ট্রেকিং-এ, তবে যখনই ঝর্ণার পানির শব্দ কানে আসছে সব ক্লান্তি যেন ধীরে ধীরে মুছে গেছে। আগের দিনের ঢালাও বৃষ্টিতে দামতুয়া তখন ফুলে ফেপে ঢোল, আর সেই দানবীয় ঝর্ণার ঠান্ডা পানিতে যখন গা ভিজালাম – মনে হলো এতো পরিশ্রম করে যাওয়াটা আসলেই সার্থক।
বাই দ্য ওয়ে, আনফরচুনেটলি ট্যুরমেট কয়েকজন খুব স্লো হওয়াতে এই ট্র্যাকিং’এ আমাদের ওয়াংপা ঝর্নাটা মিস হয়ে গিয়েছিলো। আমরা যদি আর একটু দ্রুত হতাম, সেই ঝর্নাটাও তাহলে দেখে আসা যেত।
ঝর্ণা দেখে ফিরে আসাতে মোটেও কষ্ট হয়নি, আমরা বরং পাঁচটার আগেই ফিরতে পেরেছিলাম। টোটাল ছয় থেকে সাত ঘণ্টার মত লেগেছিলো আমাদের এই ট্রেইলে। তারপর আদু পাড়া এসে চাঁদের গাড়িতে উঠে ট্যুরের প্রান্তিকে চলে এসেছিলাম, ১০ কিলো আর্মি ক্যাম্পে একবার হাজিরা দিয়ে হোটেলে চলে আসলাম… তারপর রাতের বাসে ঢাকা ব্যাক। আর সাথে দুইদিনের যে অসম্ভব ভালো লাগা স্মৃতি, তা যেন ব্রেইনের স্টোরেজ ফুল করে রেখেছিলো তখন।
➡ খরচঃ
  • ঢাকা টু আলিকদম টু ঢাকা – ৮৫০*২ = ১৭০০৳
  • মারায়ন তং থেকে দুইটা অটো রিজার্ভ সন্ধ্যা পর্যন্ত = ১০০০৳ (জনপ্রতি ৭৭ টাকা)
  • আলির গুহায় যেতে মাতামুহুরি পারাপার = ৪০৳
  • হোটেল দামতুয়া ইনে তিন রুম = ৩০০০৳ (জনপ্রতি ২৩০ টাকা)
  • চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ = ৪০০০৳ (জনপ্রতি ৩০৮ টাকা)
  • দামতুয়া ট্রেইলে গাইড = ১০০০৳ (জনপ্রতি ৭৭ টাকা)
  • দুইদিনে জনপ্রতি খাবার = ১০০০৳ (প্রায়)
আরও কিছু টুকিটাকি খরচ মিলিয়ে জনপ্রতি প্রায় ৩৫০০ টাকা খরচ হয়েছিলো আমাদের দুইদিনে।
➡ যা যা সাথে নিতে হবেঃ
  1. ভোটার আইডি কার্ড বা জন্মসনদ বা পাসপোর্ট এর ফটোকপি, না থাকলে HSC or SSC এর এডমিট কপি – দামতুয়া যাওয়ার পথে আর্মি ক্যাম্পে দেখানো লাগবে।
  2. হুটহাট বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে যথেষ্ট পরিমান পলিথিন।
  3. ট্রেক করার উপযোগী জুতা।
➡ সতর্কতাঃ
  1. ট্যুরমেট বেশি হলে ঢাকা থেকে অবশ্যই আগে বাসের টিকিট কেটে রাখবেন, নতুবা পরে ভালো সিট না পাবার পসিবিলিটি ব্যাপক।
  2. দামতুয়া ট্র্যাকিং বেশ ভালো কষ্টের। প্রয়োজনীয় পানি, হালকা খাবার সাথে রাখবেন। যেমনঃ কিসমিস,খেজুর,স্যালাইন, বিস্কিট। অনেকটা সময়ের জন্য ট্রেকিংয়ে থাকতে হবে।
  3. স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন, তার আপনাকে হেল্প করবে তাদের যথাসাধ্য।
  4. অতিরিক্ত কাপড় বা জিনিসপত্র বহন করবেন না। এতে ট্যুরে অল্পতেই হাপিয়ে উঠতে হয়।
  5. যদি ওয়াং-পা ঝর্না দেখতে চান দামতুয়ার সাথে, তবে অবশ্যই গাইডকে আগে থেকে বলে নিবেন, না হয় পরে ঝামেলা হতে পারে।
  6. ঝর্ণা, ঝিরিপথ এবং পাহাড়ের পরিবেশ সুন্দর রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন।

.
collected form (Khalid Mahmud)